X

Type keywords like Social Business, Grameen Bank etc.

পুঁজিবাদকে একটি সামাজিক বিবেক দিতে আমাদের করণীয়

পুঁজিবাদকে একটি সামাজিক বিবেক দিতে আমাদের করণীয়

(গত ১০ অক্টোবর ২০১৭দি নিউ ইয়র্ক টাইম্স পত্রিকায় অপ-এড মতামত হিসেবে প্রকাশিত ডেভিড বর্নস্টেইন কর্তৃক নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার)

ডেভিড বর্নস্টেইন । অক্টোবর ১০, ২০১৭

(ছবি) মুহাম্মদ ইউনূস, ক্রেডিট: আনদ্রেয়াস সোলারেস/এজেন্স ফ্রান্স-প্রেস -- গেটি ইমেজেস

গত ৪০ বছরেরও বেশী সময় ধরে বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী মুহাম্মদ ইউনূস দাবী করে আসছেন যে, দারিদ্রকে চিরতরে নির্মূল করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হচ্ছে মানুষের ভেতরের অব্যবহৃত উদ্যোক্তার শক্তিটাকে অবারিত করে দেয়া। তাঁর মতে, “দারিদ্র দরিদ্র মানুষদের দ্বারা সৃষ্ট হয়নি, আমরা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরী করেছি এটা তারই ফসল। দরিদ্র মানুষ হচ্ছে বনসাঁই গাছের মতো। আপনি বনের সবচেয়ে বড় গাছটার সবচেয়ে ভাল বীজটা নিলেন, কিন্তু আপনি যদি এটা ফুলের টবে রেখে বড় করতে যান তাহলে এর উচ্চতা হবে মাত্র এক মিটার। দোষ বীজের নয়। সমস্যা হচ্ছে পাত্রের আয়তনের। সমাজ দরিদ্র মানুষকে অন্য সবার মতো বেড়ে ওঠার ভিত্তিটা দেয় না। মূল সমস্যাটা এখানেই নিহিত।”

ইউনূস সম্প্রতি “The World of Three Zeros: The New Economics of Zero Poverty, Zero Unemployment and Zero Net Carbon Emissions”  শিরোনামে  একটি বই লিখেছেন যেখানে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদ একটি সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এবং তা মানবীয় প্রণোদনা সম্পর্কে একটি ভুল ধারণার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। তিনি অর্থনীতিতে সামাজিক ব্যবসার একটি অনেক বেশী শক্তিশালী ভূমিকার প্রস্তাব করছেন যাকে তিনি ব্যাখ্যা করছেন “মানুষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নিয়োজিত” “ব্যক্তিগত-মুনাফা বিহীন” কোম্পানী হিসেবে।

৭৭ বছর বয়সেও ইউনূসের মধ্যে শ্লথতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যে কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে তিনি এখনো এগিয়ে যাচ্ছেন তার পরিধি বিশাল Ñ বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ফ্রান্স, হাইতি, ভারত, জাপান, উগান্ডা এবং আরো অগণিত দেশে সামাজিক ব্যবসাকে সহায়তা দিয়ে যাওয়া বা সহ-সৃষ্টি করা ।

তাঁর বইতে তিনি লিখেছেন, “সকল সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিগত মুনাফা-কেন্দ্রিক বাজারের উপর আমাদের অবিচল বিশ্বাসটি পরিত্যাগ করতে হবে এবং স্বীকার করে নিতে হবে যে, অসমতার সমস্যাটি অর্থনীতির বর্তমান কাঠামো ও প্রচলিত কর্মপ্রণালীর ভেতর দিয়ে সমাধান হবার নয়।”

“এ অবস্থাটি কারো জন্যই সুখকর নয়, এমনকি সমাজের উচ্চতম আসনে বসা ব্যক্তিদের জন্যও। সম্পদশালী ও ক্ষমতাবানরা ... তাঁদের চলার পথে সড়কের পাশে গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত মানুষদের থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকতে কি পছন্দ করেন?  তাঁরা কি রাষ্ট্রের যন্ত্রগুলো - পুলিশি ক্ষমতা ও জবরদস্তির অন্যান্য ধরনগুলোসহ - সমাজের একেবারে নীচের সারিতে অবস্থিত মানুষদের মধ্যে সৃষ্ট অনিবার্য ক্ষোভকে দমিয়ে রাখতে ব্যবহার করাটা পছন্দ করেন? তাঁরা কি তাঁদের নিজেদের সন্তান ও নাতি-নাতনীদের জন্যও এ-রকম একটা পৃথিবী রেখে যেতে চান?

গত সপ্তাহে তাঁর নতুন বইটি নিয়ে আলোচনা করতে আমি ইউনূসের সাথে বসেছিলাম।

ডেভিড বর্নস্টেইন: বইটি একই সাথে একটি সমাধান চিহ্নিত করার বই ও একটি সতর্কবানী। বিপদটি কোথায়?

মুহাম্মদ ইউনূস: বিপদটি সম্পদ কেন্দ্রীকরণের মধ্যে। বইটিতে আমি অক্সফামের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেছি যেখানে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর মাত্র আট জন লোকের সম্পদের মোট পরিমাণ পৃথিবীর নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশী। অতি সম্প্রতি একটি পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনে দেখলাম যে,  এই সংখ্যাটি এখন  পাঁচ জনে নেমে এসেছে। এখানে দুশ্চিন্তা করার দু’টি কারণ রয়েছে: সম্পদের কেন্দ্রীকরণ এবং এই কেন্দ্রীকরণের গতি। যখন ৫,০০০ বা ৫০,০০০ লোকের হাতে পৃথিবীর নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের চেয়ে বেশী সম্পদ কেন্দ্রীভূত ছিল তখন আমরা বিষয়টির দিকে নজর দিইনি। এখন সংখ্যাটি পাঁচ জনে নেমে এসেছে। এক বা দুই বছরের মধ্যে এটি মাত্র একজনে এসে ঠেকবে। আর এটা এই গতিতেই ঘটে চলছে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটি এমন একটি যন্ত্র যা নিচের দিক থেকে সম্পদ শোষণ করে তা একবারে উপরের তলায় পাঠায়।  এই দোষ একেবারে উপরের তলায় থাকা লোকদের নয়। তারা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তাদের যা করতে বলে তাই অনুসরণ করে: অর্থের পেছনে ছোটা। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সম্পদ একটা বিশাল মাশরুমের মতো স্বল্প থেকে স্বল্পতর লোকের হাতে একেবারে উপরের দিকে জড়ো হয় - আর এটা এই সরল কারণে যে, যাদের যতো বেশী আছে, তারা ততো বেশী পায়। সম্পদ হচ্ছে চুম্বকের মতো। আপনার একটি ছোট চুম্বক থাকলে আপনি অল্প সম্পদ আকৃষ্ট করতে পারবেন। আপনার কাছে বড় চুম্বক থাকলে আপনি বেশী আকৃষ্ট করতে পারবেন। আর এই সম্পদ মাশরুমটি পারমানবিক মাশরুম মেঘের চেয়েও খারাপ। এটা আমাদের রাজনীতিকে ধ্বংস করবে, আমাদের সমাজকে ধ্বংস করবে, আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করবে -  কারণ সম্পদের কেন্দ্রীকরণ ক্ষমতারও কেন্দ্রীকরণ ঘটায়। এর ফলে নীচের দিকে প্রবল ক্ষোভ পুঞ্জীভুত হবে আর এই ক্ষোভ সবকিছু এলোমেলো করে দেবে। ব্রেক্সিট এই ক্ষোভেরই ফল। একই জিনিষ সাম্প্রতিক মার্কিন নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। এখন জার্মানীর নির্বাচনের দিকে দেখুন। এই মাশরুমটি একটি বাজতে থাকা টাইম বোমার মতো। এই দুশ্চিন্তায় এখন আমাদের বহু রাত অনিদ্রায় পার করতে হচ্ছে।

ডেভিড বর্নস্টেইন: আপনি বলছেন যে, সমস্যাটি পুঁজিবাদী তত্ত্বের গোড়াতে নিহিত।

মুহাম্মদ ইউনূস: পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটি একটি মৌলিক ক্রুটির, মানুষ সম্পর্কে একটি ভুল ব্যাখ্যার উপর দাঁড়িয়ে আছে। পুঁজিবাদী তত্ত্বে ধরে নেয়া হয় যে, একজন মানুষ সম্পূর্ণভাবে আত্ম-স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। এটি নিশ্চিতভাবে মানব চরিত্রের প্রকৃত ব্যাখ্যা নয়। মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা আছে, তবে সে একই সাথে একই পরিমানে পরার্থপরও, যদি এর বেশী নাও হয়। অ্যাডাম স্মিথ তাঁর  “The Theory of Moral Sentiments”  গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন। তিনি দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি নৈতিকতা বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। এরপর তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি বই লিখলেন যেখানে আত্ম-স্বার্থ ও “অদৃশ্য হাত”-এর কথা  বললেন। প্রথম বইটির কথা সবাই ভুলে গেল। তিনি বই দু’টিকে কখনো সমন্বিত করেননি।

ডেভিড বর্নস্টেইন: এই দু’টি ধারণাকে সমন্বিত করা হলে ফলাফল কী হবে?

মুহাম্মদ ইউনূস: পুঁজিবাদে বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শুধু এক ধরনের ব্যবসা রয়েছে: অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবসা - এবং এটিকে আরো চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে একথা বলে যে, এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় মুনাফা সর্বোচ্চকরণের মাধ্যমে। আমরা যখন মানুষের পরার্থপরতাকে ব্যবসার জগতে নিয়ে আসি তখন আমরা অন্য একটি বিকল্প পন্থার সৃষ্টি করতে পারি। প্রথাগত ব্যবসার পাশাপাশি আমরা অন্য এক ধরনের ব্যবসা চালু করি যা ব্যবসার মধ্য দিয়ে আমাদের পরার্থপরতাকে প্রকাশিত হবার সুযোগ করে দেয়। এই ব্যবসাটির, যাকে আমি সামাজিক ব্যবসা বলছি, একমাত্র লক্ষ্য হবে মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা। আমার বইতে এর বহু উদাহরণ রয়েছে।

ডেভিড বর্নস্টেইন: আমার মনে হয় কোনো কোনো পাঠক ভাবতে পারেন, “আদর্শবাদীর মতো শোনাচ্ছে।”

মুহাম্মদ ইউনূস: প্রকৃতপক্ষে এটা খুবই বাস্তব একটা বিষয়। পুরোপুরি ব্যবসায়িক মনোভাবের ব্যক্তিরা সবসময় আমার কাছে আসছেন এবং সামাজিক ব্যবসা তৈরীতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে কাজ করছেন। এদের একটি কানাডিয়ান কোম্পানী ম্যাককেইন ফুড্স। তারা আমাদের সাথে যৌথভাবে সামাজিক ব্যবসা তৈরী করতে চাইলো। পৃথিবীজুড়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মার্কেটের ৬০ শতাংশ তাদের কাছে। আমরা কলম্বিয়ায় তাদের সাথে যৌথভাবে একটি সামাজিক ব্যবসা করছি। পৃথিবীর বহু দেশের মতো কলম্বিয়ার বহু চাষী বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আমাদের সামাজিক ব্যবসাটি যার নাম ক্যাম্পো ভিভো চাষীদেরকে উচ্চ ফলনশীল আলু ও সব্জি চাষ করতে সাহায্য করছে।

এরপর তারা ফ্রান্সে আরেকটি সামাজিক ব্যবসা তৈরী করলো। সেদেশে উৎপাদিত আলুর ২৬ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায় শুধু এ কারণে যে, সেগুলোর আকৃতি ফ্রান্সের ফ্রাই তৈরীর মেশিনগুলোর সাথে সমঞ্জস্য নয়। ম্যাককেইন যখন সামাজিক ব্যবসার চশমাটি চোখে লাগালো তখন তারা নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পেল। তারা বঁ এ ভিভো নামে একটি কোম্পানী সৃষ্টি করলো যা এই আলুগুলো কিনে আলুর স্যুপ তৈরী করতে শুরু করলো। তারা এ কাজে বেকারদের নিয়োজিত করলো। এরপর তারা লক্ষ্য করলো যে, ইউরোপে উৎপাদিত ৩০ শতাংশ সব্জিই ফেলে দেয়া হয় শুধু এ কারণে যে, সেগুলো সুপারমার্কেটের উপযোগী আকৃতির নয়। এই সব্জিগুলোকে বলা হয় “কুৎসিত সব্জি”। সামাজিক ব্যবসা কোম্পানীটি এই ফেলে দেয়া সব্জিগুলো কিনে নিয়ে সেগুলো টুকরো টুুকরো করে ও রন্ধনের উপযোগী করে ছোট ছোট প্যাকেটে বিক্রি করে থাকে। এ থেকে তারা টাকা কামাতে পারতো, কিন্তু তারা অন্য সিদ্ধান্ত নিলো - তারা এই ভালো স্যুপ ও সব্জি কম দামে বিক্রি করছে। ব্যক্তিগত মুনাফা তাদের উদ্দেশ্য নয়।

ডেভিড বর্নস্টেইন: প্রচলিত ব্যবসাগুলো সব সময়েই সমস্যার সমাধান করে যাচ্ছে। এ থেকে ব্যক্তিগত মুনাফার উদ্দেশ্যটা বাদ দিলে আমরা কী পাচ্ছি?

মুহাম্মদ ইউনূস: আপনি যদি ব্যক্তিগত মুনাফার লক্ষ্যটা বাদ দেন এবং শুধু সমস্যা সমাধানের কথা ভাবেন, তাহলে আপনি হঠাৎ করেই অনেক সম্ভাবনা দেখতে পাবেন যা আগে আপনার চোখে পড়েনি। যদি পরার্থপরতা ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের পরিবর্তে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পেছনের চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে প্রযুক্তি হঠাৎ করেই পৃথিবীকে বদলে দেবার একটি প্রচন্ড শক্তিতে রূপান্তরিত হবে। তখন চাকরী কেড়ে নেবার বদলে মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নতুন প্রযুক্তি আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স গড়ে উঠবে। আপনি যদি মানব চরিত্রের পরার্থপর দিকটির দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন তাহলে অর্থনীতির পুরো চেহারাটাই পাল্টে যাবে।

ডেভিড বর্নস্টেইন: এর অর্থায়ন কোথা থেকে হবে?

মুহাম্মদ ইউনূস: বিভিন্ন দিক থেকে। দানশীলতার অর্থ একটি বড় উৎস হতে পারে। অনেকেই এখন সামাজিক ব্যবসা তহবিল সৃষ্টি করছেন। ব্যক্তিগত সম্পদ একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। হেজ ফান্ড বা ইন্স্যুরেন্স ফান্ড, পেনশন ফান্ড - এই তহবিলগুলো তাদের ১ শতাংশ অর্থ সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারে যেখান থেকে কোনো ব্যক্তিগত মুনাফা প্রত্যাশা করা হবে না। এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ সন্নিবেশিত হতে পারে।

ডেভিড বর্নস্টেইন: আগ্রহী ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্দেশ্যে আপনার বক্তব্য কী?

মুহাম্মদ ইউনূস: তাদেরকে বলি, চেষ্টা করে দেখুন। আপনাদের সম্পদ বা কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্বের অর্থ বা ফাউন্ডেশনের অর্থের একটি অংশ সামাজিক ব্যবসায়ে ব্যবহার করুন। আপনাদের কেউ ব্যবসাগুলোর মধ্যে একটি ডিজাইন কম্পিটিশন আহ্বান করতে পারেন যাঁরা তাদের পছন্দের কোনো একটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে চান। এখানে অনেক ধরনের ব্যবসায়িক আইডিয়া পাওয়া পাবে। এদের মধ্য থেকে একটি বা দু‘টি আইডিয়া নিয়ে সেখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। কোনো প্রচারণার উদ্দেশ্যে নয়। নিশ্চিত করতে হবে যে এটা প্রকৃতই মানুষের কোনো সমস্যার সমাধান করছে। এতে কাজ করতে গিয়ে আপনি নিজের সর্ম্পকেও অনেক কিছু জানতে পারবেন।

ডেভিড বর্নস্টেইন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ আমেরিকায় আপনার কাজ কেমন চলছে?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা ২০০৮ সালে গ্রামীণ আমেরিকার কাজ শুরু করি। আগামী বছরের শেষে গ্রামীণ আমেরিকা ১ লক্ষ ঋণগ্রহীতাকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেবার মাইল ফলক অতিক্রম করবে, যার আদায় হার হবে প্রায় ১০০ শতাংশ। আগামী ১০ বছরের মধ্যে গ্রামীণ আমেরিকা তার শাখার সংখ্যা দ্বিগুণ করতে - ২০ থেকে ৪০-এ উন্নীত করতে চাচ্ছে। শাখার সংখ্যা দ্বিগুণ করে ২০২৮ সালের মধ্যে গ্রামীণ আমেরিকা ৫ লক্ষ ঋণগ্রহীতার কাছে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করছে। পর্যাপ্ত তহবিল পাওয়া গেলে ১০ লক্ষ ঋণগ্রহীতার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকিং লাইসেন্স থাকলে তাহলে অন্য কারো কাছ থেকে ডিপোজিট গ্রহণ করতে পারতো, বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক যেমনটা করে থাকে, আর সেক্ষেত্রে এটার সম্প্রসারণ তহবিলের প্রাপ্যতার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতো না।

ডেভিড বর্নস্টেইন: আপনি তরুণদের দেখছেন একটি “বৃহৎ শক্তি” হিসেবে যা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। তরুণরা কেন?

মুহাম্মদ ইউনূস: তাদের মন উন্মুক্ত। তারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর নয়। তারা সাহসী চিন্তা করতে পারে। তাদের প্রচুর শক্তি আছে, তারা প্রযুক্তি বোঝে, এবং তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার একটা প্রবল আগ্রহ রয়েছে।

ডেভিড বর্নস্টেইন: আপনি শিক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে দেখতে চান?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমি চাই তারা তাদের পাঠ্যসূচিতে এই ধারণাটা নিয়ে আসুক যে, ব্যবসা মানেই ব্যক্তিগত মুনাফা সর্বোচ্চকরণ নয়। আপনি এটা এমনভাবে তৈরী করতে পারেন যা মানুষের সমস্যার সমাধান করবে এবং একই সাথে আপনি আপনার খরচটা তুলে আনতে পারবেন এবং আপনার অর্থ পুনঃবিনিয়োগ করতে পারবেন। তাদেরকে সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ব্যবসা ডিজাইন করার অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া যেতে পারে: কীভাবে একটি গ্রামে সুপেয় পানি নিয়ে যাওয়া যায়; কীভাবে দুর্গম কোনো জনগোষ্ঠীর কাছে শিক্ষা, সাক্ষরতা, গৃহায়ন বা স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে যাওয়া যায়; কীভাবে একটি ঘনবসতি বস্তিতে স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, ভালো সড়ক পৌঁছে দেয়া যায়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন সামাজিক ব্যবসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করছে এবং এগুলো শেখাচ্ছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রচলিত এম.বি.এ. ডিগ্রী দেয়ার সাথে সাথে সামাজিক এম.বি.এ. কোর্স অফার করা উচিত।

ডেভিড বর্নস্টেইন: আপনি পৃথিবী জুড়ে যারা ব্যবসা সম্পর্কে প্রচলিত চিন্তাধারাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে তাদেরকে আকৃষ্ট করছেন। আপনি তাদের মধ্যে কোন বিষয়গুলোতে মিল খুঁজে পান?

মুহাম্মদ ইউনূস: উত্তেজনা। সামাজিক ব্যবসার এই পোকা আপনাকে একবার দংশন করলে আপনি বসে থাকতে পারবেন না। টাকা রোজগার করারটা যদি সুখের হয়, তাহলে অন্যদের সুখী করাটা পরম সুখের।

ডেভিড বর্নস্টেইন: আগামী ১০ বছর পরের দিকে তাকালে আপনি কী দেখতে পান?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমি আশা করছি যে, বৈশ্বিক পর্যায়ে অর্থনীতির অন্তত ১ শতাংশ হবে সামাজিক ব্যবসা অর্থনীতি। এটা নিশ্চিত করা গেলে বুঝতে হবে পোকাটা দংশন করেছে। এরপর শুধু এগিয়ে যাবার পালা।

ডেভিড বর্নস্টেইন: আপনি কি মনে করেন যে, আপনি যদি সম্পদ অর্জনকেই আপনার লক্ষ্য স্থির করতেন তাহলে আপনি খুব ধনী হতে পারতেন?

মুহাম্মদ ইউনূস: হয়তোবা। আমি অনেকগুলো ব্যবসা তৈরী করেছি। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও আমার সৃষ্ট কোনো  ব্যবসায়ে আমার একটা শেয়ারও নেই। কিন্তু এতে আমি কিছুই হারাইনি। আমি যেসব বিষয় নিয়ে ভাবি আমি সেগুলো নিয়ে কাজ করছি, এবং মানুষ মনোযোগ দিচ্ছে, শিখতে ও শুনতে চাচ্ছে, এবং সবশেষে, জীবনের লক্ষ্যটাই বা কী? কোটি কোটি টাকা কামানো? পৃথিবীর সেই পাঁচ জন ব্যক্তি যাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ পৃথিবীর নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মনুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশী Ñ তাঁদের একেকজনের সম্পদের পরিমাণ ৭৫ কোটি মানুষের সম্পদের সমপরিমাণ! এতো সম্পদ দিয়ে আপনি কী করবেন? খাবেন? বাড়ী করবেন? গান শুনবেন? দান করবেন? আমার কাছে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জগতে সুখী হবার, জীবনকে উপেভোগ করার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল উপায় হচ্ছে সামাজিক ব্যবসা।

ডেভিড বর্নস্টেইন একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর “How to Change the World”  ২০টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি  “The Price of A Dream: The Story of the Grameen Bank”  গ্রন্থের প্রণেতা এবং “Social Entrepreneurship: What Everyone Needs to Know”   গ্রন্থের সহ-প্রণেতা। এছাড়াও তিনি Solutions Journalism Network -এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা যা বিশেষভাবে সামাজিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রণয়নে সহায়তা দিয়ে থাকে।