মুহাম্মদ ইউনূসের উপর বাংলাদেশ সরকারের আক্রমণ হচ্ছে মানবাধিকারের উপর আক্রমণ
ব্যবসায়ী এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বিনোদ খোসলা এর একটি নিবন্ধ "মুহাম্মদ ইউনুসের উপর বাংলাদেশ সরকারের আক্রমণ মানবাধিকারের উপর আক্রমণ।" গত ১০ মে ২০২৪ - এ দ্য ওয়্যারে প্রকাশিত হয়।
দ্য ওয়্যারের নিবন্ধটির লিংক: https://thewire.in/south-asia/bangladesh-govts-attack-on-mohammad-yunus-is-an-attack-on-human-rights
মূল নিবন্ধের বাংলা অনুবাদ
----------------------------------------------
মুহাম্মদ ইউনূসের উপর বাংলাদেশ সরকারের আক্রমণ হচ্ছে মানবাধিকারের উপর আক্রমণ
বিনোদ খোসলা
ইউনূসকে টার্গেট করার মাধ্যমে, সরকার সংস্কারক এবং সামাজিক উদ্যোক্তাদের টার্গেট করছে যারা তাদের কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহস দেখায়।
ঠিক এমূহু্র্তে ৮৩ বছর বয়সী একজন বাংলাদেশি কারাগারে যাবার জন্য অপেক্ষা করছেন । বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক হয়রানি এবং হুমকির একটি ভিত্তিহীন ক্যাম্পেইন এর পর অন্যায় অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিচারের নামে বিদ্রুপ স্বরূপ এই মামলাটি বিশেষ করে মর্মপীড়াদায়ক হবার বড় কারণ হচ্ছে মামলার আসামী হলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
"ক্ষুদ্রঋণের জনক" হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত, ইউনূস তার সমগ্র জীবন দরিদ্রদের জন্য, বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য উৎসর্গ করেছেন এবং সামাজিক ব্যবসা তৈরি করার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষকে, বিশেষ করে মহিলাদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে সাহায্য করেছেন। ইউনূস এবং তার সব থেকে সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক "সমাজের নিম্নস্তর থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন তৈরি" করার প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
বর্তমানে, বিশ্বের বৃহত্তম ক্ষুদ্র-অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর ৯৫% এরও অধিক ঋণগ্রহিতা হচ্ছে মহিলারা। গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান এবং ইউনূস কর্তক প্রতিষ্ঠিত আরও অনেকগুলি অনন্য প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্মভূমি হিসাবে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে সামাজিক উদ্ভাবন এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টির জোয়ার তৈরীর পীঠভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের মডেল এবং প্রফেসর ইউনূসের আরো অনন্য পদ্ধতিগুলো এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং এমনকি উত্তর আমেরিকা ব্যাপী অনুসরণ করা হচ্ছে ।
১৯৮০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত, সামাজিক উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার এই সাফল্যে অবদান রেখেছে। সরকার গ্রামীণ মডেলের অগ্রগতি এবং তার প্রতিরূপ বিস্তারে সহযোগিতা করার জন্য কৃতিত্ব পাওয়ার যোগ্য।
গত দশ বছরে কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নিয়েছে। সরকার উল্টা পথ গ্রহণ করেছে। ইউনূসকে হয়রানি ও অপমান করার জন্য বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ক্যাম্পেইন দ্বারা একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তার বিরুদ্ধে ১৭০টিরও বেশি উটকো মামলা করেছে এবং অন্যদের প্রণোদিত করেছে এবং তার নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তিগত হুমকি দিয়েছে। এই মামলাগুলি প্রধান মানবাধিকার গ্রুপগুলো কর্তৃক খুব তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে।
এই বছরের প্রথম দিকে আদালত ইউনূসকে মিথ্যা অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। এর পর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ননপ্রফিট প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে আটটির অফিস আকস্মিকভাবে জোরপূর্বক দখলের চেষ্টা করে। জোরপূর্বক দখলকারীদের বাধা দেয়া থেকে পুলিশ বিরত থাকে। দখলকারীদের উচ্ছেদ করা দূরে থাকুক তদন্তের জন্য তারা কোন পদক্ষেপও নেয়নি।
বর্তমানে ইউনূস জামিনে মুক্ত আছেন। তার আইনজীবীরা তার দন্ডাদেশ উলটিয়ে দেওয়ার জন্য আপিল চালিয়ে যাচ্ছে৷
ইউনূসের উপর আক্রমণ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এগুলি তাঁর নীতিসমূহের উপরও আক্রমণ, যার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিজেকে নিবেদিত করেছেন – সামাজিক ন্যায়বিচার, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন। তারা বাংলাদেশী নারীদের কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্যও হুমকিস্বরূপ। ইউনূসকে টার্গেট করার মাধ্যমে, সরকার সংস্কারক এবং সামাজিক উদ্যোক্তাদের টার্গেট করছে যারা তাদের কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহস দেখায়। আইনের শাসনের এই ভেঙ্গে পড়াটা বাংলাদেশে ব্যবসা বা বিনিয়োগের কথা যারা চিন্তা করেন তাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে। ইউনূস ও তার কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রে যদি আইনের শাসন অনায়াসে ব্যর্থ হয় দেশের কে আর নিজেকে এখন নিরাপদ বিবেচনা করবে।
ইউনূসের প্রতি দু্র্ব্যবহার এবং তাকে যে হয়রানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তার প্রতিবাদ করার জন্য আমি, ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে যোগ দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর প্রতিকূল প্রচারণা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বেশ কয়েকটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছিলাম, যা ভারতে এবং অন্যান্য দেশে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে । রাজনৈতিক প্রতিহিংসা শেষ পর্যন্ত জাতির মঙ্গলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আসুন আমরা একটি ভিন্ন ধরনের ভবিষ্যৎ কল্পনা করি, যেখানে বাংলাদেশ সরকার ইউনূসের মতো সংস্কারক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ প্রদর্শককে সামাজিক অগ্রগতি বেগবান করার জন্য উৎসাহিত করে এবং যেখানে ইউনূস সমগ্র পৃথিবীব্যাপী মানুষের কাছে সম্ভাবনার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে।
এই দৃশ্যপটে দেখা যাবে বাংলাদেশ ব্যবসা ও উন্নয়নের পীঠস্থান হিসেবে বিশ্বে আরো স্বীকৃতি পাচ্ছে, ভারত সহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে একটি স্বাস্থ্যকর এবং পারস্পরিকভাবে উপকারী সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছে, দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় মডেল কর্মসূচির পাশাপাশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করেও বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইতিমধ্যেই যেমনটি রিচার্ড ব্র্যানসন করেছেন, আমিও তার মত, ভারতের এবং তার বাইরের সকল ব্যবসায়িক এবং সরকারী নেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি ভিন্নধর্মী পথ নির্বাচন করে নিতে রাজি করার চেষ্টা করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি – যেটি তার জনগণ এবং তার নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অধিক ভাল হবে।
বিনোদ খোসলা
একজন ব্যবসায়ী এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট।
সমাপ্ত।