X

Type keywords like Social Business, Grameen Bank etc.

তুমিই বাংলাদেশ

তুমিই বাংলাদেশ

তুমিইবাংলাদেশ

মুহাম্মদইউনূস

এক

দুই সহপাঠীর অপঘাত মৃত্যুর প্রতিবাদে স্কুলের শিশুকিশোররা রাস্তায় নেমেছে রাস্তায় তারা শুধু শোক প্রকাশ করে থেমে থাকেনি - এরকম শোক যাতে ভবিষ্যতে কাউকে করতে না-হয়, তার জন্য ব্যবস্থা চায় তারা তারা নিরাপদ সড়ক চায় সড়ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তারা প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে শুধু তাই নয়, তারা নিজেরা এই ব্যবস্থাপনায় নেমে গিয়ে দেখাতে চেয়েছে যে, আইনের প্রয়োগের অভাবেই মূলত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তারা বাংলাদেশের মূল রোগটাকে সবার সামনে নিয়ে এসেছে তারা আইনের প্রয়োগ চায় যে প্রয়োগের নমুনা দেখানোর জন্য তারা গাড়ী চালকের লাইসেন্সের পেছনে লেগেছে ফিটনেস সার্টিফিকেটের সন্ধানে লেগেছে আইনের প্রয়োগ করা যে সহজ বিষয় এবং সমাজে সবার সমর্থন পাবার বিষয়, সেটাও তারা দেখিয়ে দিলো যারা আইনের প্রয়োগকারী তারা নিজেরাই যে আইন মানছে না সেটাও তারা দেখিয়ে দিলো তা- কোনো বাহাদুরী করার জন্য নয় নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আজ পর্যন্ত তাদের কারো মুখে বড়াই করতে শুনিনি, পত্রিকায় কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ গর্ব করে বলেনি যে আজ আমি এতজন লাইসেন্স বিহীন চালককে ধরতে পেরেছি

তাদের শৃংখলা দেখে হতবাক হয়েছি বালখিল্যতার লেশমাত্র নেই কোথাও প্রগাঢ় পরিপক্কতার চিহ্ণ সর্বত্র বিভিন্ন স্থানে স্বতঃস্ফুর্তভাবে লেখা প্ল্যাকার্ডগুলি ইতিহাসে স্থান পাবার মত তারা ম্যানেজমেন্ট থিউরির মূল প্রতিপাদ্যকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে সুশৃংখলভাবে তাদের কাজ নিয়ে এগিয়ে গেছে নিজ নিজ উদ্যোগে, কেন্দ্রীয় কোনো উদ্যোগ ছাড়া তারা কোনো কমান্ড-কাঠামো তৈরী করেনি, কোনো কম্যুনিকেশান চ্যানেল স্থাপন করেনি, কোনো প্রশিক্ষণের অপেক্ষায় থাকেনি, নীতিমালা তৈরী করার প্রয়োজন বোধ করেনি, কোনো কনসালটেন্টের স্মরণাপন্ন হয়নি তারা তাদের মত করে সুশৃংখলভাবে একমনে কাজ করে গেছে

সরকার তার সমস্ত বুদ্ধিমত্তাদিয়ে এখন শিশুকিশোরদের হাত থেকে রাজপথ মুক্ত করার কাজে লেগেছে একনিষ্ঠভাবে সরকার একটা বিরাট সুযোগ হাতছাড়া করে ফেললো রাজপথ মুক্তির অভিযানে না-গিয়ে সরকার সুন্দরভাবে শিশুকিশোরদের, তাদের বাবা-মাদের, দেশের সকল মানুষের ক্ষোভমুক্তির কাজে নামলে রাজপথও মুক্ত হতো, শিক্ষার্থীরাসহ সকল মানুষের বাহবা পেতো লাইসেন্সবিহীন চালক এবং ফিটনেস সার্টিফিকেটবিহীন গাড়ী চিহ্ণিত করা কি এতই কঠিন কাজ?

রাস্তায় নামা শিশুকিশোরদের দেখে সবাই অভিভূত হয়েছে এই স্মৃতি জাতি কখনো ভুলবে না তারা কান্নাকাটি করার জন্য বা শোকের মাতম করার জন্য রাস্তায় নামেনি তারা সমাধান নিয়ে নেমেছে অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতার সাথে নেমেছে সুশৃংখলতার সাথে তারা কাজ করে গেছে কোনো গলাবাজী ছিলো না, রাতব্যাপী নিজেদের মধ্যে বক্তব্য বা কর্তব্য স্থির করার জন্য বাকবিতন্ডা হবার কথা শুনিনি কারো মুখে এমন কোনো ভাব দেখিনি যাতে মনে হয়েছে যে, কিশোর কিশোরী অজানা কাজের দায়িত্ব পেয়েছে বলে কোনো অনিশ্চয়তায় ভুগছে তাকে যেখানেই যেকাজে দেখেছি মনে হয়েছে যেন একজন প্রশিক্ষিত দক্ষ কর্মকর্তা তার দায়িত্ব পালন করেছে তার হাতে কোনো ওয়াকি-টকি নেই  অস্ত্রনেই শুধু আছে বৃষ্টিতে ভেজা স্কুলের পোষাক, সারাদিন না খেতে পাওয়া শুকনা মুখ, পিঠে বইয়ের ব্যাগ

এরা কারা? এরা কোন গ্রহের বাসিন্দা? এরা কি আমাদেরই সন্তান? এরা কি আমাদের মেরুদন্ডহীন অস্তিত্বের পরিবেশে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্ম? বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না তাহলে কি আমাদের মেরুদন্ড আসলে হারিয়ে যায়নি? শুধু কৌশলগত কারণে লুকিয়ে রেখেছি? তাহলে কি আমাদের শিশুকিশোররা বড়দের এই মেরুদন্ড লুকানোর খেলাটা বুঝতে পারার আগেই মা-বাবার দেয়া আনকোড়া নতুন মজবুত মেরুদন্ড নিয়ে রাজপথে নেমে গেছে? তাদের দেখে চোখে আনন্দাশ্রু এসে পড়েনি -রকম মা-বাবা কি দেশে পাওয়া যাবে?

দুই

শিশুকিশোরদের রাস্তায় নামার পর থেকে আমার কাছে নানাজনে অনুরোধ পাঠাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন, কিছু উপদেশ দিন, তাদেরকে দিক-নির্দেশনা দিন আমি তাদের দিকে তাকালে বুঝে উঠতে পারিনা কী উপদেশ দেবো? পরে বুঝতে পারলাম কেন কোনো উপদেশ আমার মাথায় আসছে না আমরা বড়রা তাদের উপদেশ দেবার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি আমরা গর্তের ভেতর থাকা মানুষ গর্তের ভেতরে থেকে উপদেশ দেয়া যায় না

তাদের প্রতি আমার একটাই পরামর্শ তোমরা আমাদের উপদেশ শুনবে না অন্ধ মানুষ চক্ষুষ্মানকে চলার উপদেশ দিতে পারে না তাদেরকে বলবো: তোমরা আমাদেরকে উপদেশ দেবার সুযোগ দিও না যদি একবার সুযোগ দাও তাহলে তোমাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে আমাদের গর্তে না ঢোকানো পর্যন্ত আমরা আর থামবো না

আমরা এখন আর চোখে দেখি না চোখের উপর একটা আস্তরণ টেনে দিয়েছি স্বেচ্ছায় নানা ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের এই ইচ্ছাকৃতভাবে না-দেখাটা যাতে ধরা না-পড়ে আমরা তার নিরন্তর প্রচেষ্ঠায় থাকি তোমরা আমাদের মত স্বেচ্ছাঅন্ধের কথায় কর্ণপাত করো না কর্ণপাত করো না বলেই তোমরা রাস্তার দায়িত্ব নিতে পেরেছো যারা নিজেরা পথ চেনে না, তারা পথ দেখাবে কী করে আমাদের পরামর্শ নিলে তোমরাও গর্ত বানানোর কাজে লেগে যেতে 

তোমরা পথ বের করেছো তোমরা তোমাদের পথেই থাকো তোমরা তোমাদের প্ল্যাকার্ডে অত্যন্ত সুন্দর করে তোমাদের সব কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়োছো তুমি বলেছ, “তুমি বাংলাদেশসেটাই সবচয়ে খাঁটি কথা অন্য কোনো বাংলাদেশকে তুমি স্বীকার করো না তোমার মত করে তুমি তোমার বাংলাদেশকে বানিয়ে নাও তুমি বলেছ: “তুমি যদি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, তুমি যদি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশতুমি রুখে দাঁড়িয়েছ, তাই তুমি বাংলাদেশ তুমি বলেছ: “আমরা যদি না-জাগি মা, ক্যামনে সকাল হবেতোমরা জেগেছো, এবার সকাল হবে আমরা যারা চোখে দেখেও দেখিনা তাদের চোখের পর্দা এই ভোরের জ্বলন্ত আলো দিয়ে কেটে দাও আমাদেরকে তোমাদের সঙ্গে থাকার উপযুক্ত করে নাও তুমি যেমন বাংলাদেশ, আমাকে তোমার মত করে বাংলাদেশ হবার মতো উপযুক্ত করে নাও

গর্তে গুঁজে থাকা আমাদের শীতল নিস্তেজ শরীরে তোমারা আগুন ছড়িয়ে দাও যদি আগুনেরকোনো ছিটেফোঁটা আমাদের শরীরে এবং মনে এখনো থেকে থাকে, তবে হয়তো তোমার আগুনে সেটা আবার উত্তাপ ফিরে পাবে

তোমরা রাতের অন্ধকার থেকে জ্বলন্ত সকালকে টেনে বের করে আনার ব্রতে নেমেছো তোমরাই পারবে আমাদের হিমশীতল অস্তিত্ব থেকে টগবগে বাংলাদেশকে বের করে আনতে

তুমিই বাংলাদেশ!

তোমার চোখেই দেখতে চাই বাংলাদেশকে তোমার মনের রং মেখে রাঙিয়ে দিতে চাই আমাদের মনগুলিকে

-----